বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫, ০২:৩৩ পূর্বাহ্ন
শেখ রোকন:
শেষ পর্যন্ত আটটি বামপন্থি রাজনৈতিক দল মিলে নতুন একটি জোট গঠন করেছে। সিপিবি, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন এই জোটে রয়েছে। গত সপ্তাহে ঢাকার পুরানাপল্টনের মুক্তি ভবনে (সিপিবি ভবন) এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে রয়েছে সিপিবি, বাসদ, বিপল্গবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপল্গবী পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। প্রসঙ্গত, এই আটটি রাজনৈতিক দল আগে থেকেই দুটি জোটে অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিপিবি, বাসদ জোট এবং বাকি ছয় দলের গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। নতুন জোট গঠনের মধ্য দিয়ে ওই দুই জোটের আপাত অবসান হলো। অবশ্য আরও আগে, এই দলগুলোরই বেশিরভাগের সমন্বয়ে নব্বই দশকের শেষ দিকে অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের আদলে গঠিত হয়েছিল বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। প্রায় একই সময়ে প্রাথমিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরেকটি জোট ‘যুক্ত ফ্রন্ট’। জোটের ভাঙাগড়ার ইতিহাস নতুন না হলেও এটা অস্বাভাবিক নয় যে, নতুন এই দুই জোট আগামী নির্বাচন সামনে রেখে অনেকের মধ্যে তৈরি করতে পারে নতুন আশাবাদ।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে বাংলাদেশে বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর আলাদা একটি জোটের কথা অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। জনসাধারণের মধ্যে এমন একটি জোটের ‘আকাঙ্ক্ষা’ উচ্চারিত হচ্ছিল আরও আগে থেকে। এমন নয় যে, বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশি বামপন্থি দলগুলোর বিপুলসংখ্যক সমর্থক রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য অ-বামপন্থি রাজনৈতিক দলের সমর্থক, এমনকি সদস্য হয়েও বামপন্থি রাজনৈতিক দল বা বামপন্থার শুভাকাঙ্ক্ষী আমাদের দেশে কম নয়। তারাই চেয়েছে বামপন্থি দলগুলোর ঐক্য হোক। সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অহরহই এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হতে দেখা গেছে। বামপন্থিদের ঐক্য ও শক্তি যে দেশের অপরাপর উদার, সেক্যুলার ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির জন্য সহায়ক হয়, এই সত্য বাংলাদেশের সাড়ে চার দশকের ইতিহাসে অনেকবারই প্রমাণ হয়েছে।
ষাট ও সত্তর দশকের ‘স্বর্ণালি সময়’ বাদ দিলেও আশির দশকেও বাংলাদেশের বামপন্থি দলগুলোর প্রবল প্রাসঙ্গিকতা ছিল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি সরকারের বিরুদ্ধে আশির দশকে যে সাতদলীয়, আটদলীয় বা ১৫ দলীয় জোটের যে রাজনৈতিক তৎপরতা, সেখানে বামপন্থি নেতারা ছিলেন অনিবার্য অনুষঙ্গ। মজার ব্যাপার, আশির দশকের ‘ক্ষমতাসীন’ গোষ্ঠীর মধ্যেও বামপন্থি রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দল তার প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করেছিল। এর তাৎপর্য কেবল কাজী
জাফর আহমেদের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নয়, বরং আ স ম আবদুর রবের বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার মধ্যেও নিহিত ছিল। নিহিত সেই তাৎপর্য যেন নব্বইয়ের দশকে এসে নিহত হয়ে গিয়েছিল।
হতে পারে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণে কিংবা চীনে ধ্রুপদী সমাজতন্ত্র ফিকে হয়ে আসার কারণে। নব্বইয়ের দশকে এসে বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো দৃশ্যত খানিকটা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। সবচেয়ে বড় বামপন্থি রাজনৈতিক দল সিপিবির একটা অংশ রাজনীতি থেকেই নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। বস্তুত নব্বই দশক যেন বাংলাদেশের বামপন্থিদের জন্য বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত হওয়ার দশক। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও ওই দশকে বামপন্থিরা যখন ক্রমশ কেন্দ্রীয় ক্ষমতার নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হচ্ছিল, তখন বাংলাদেশে আশির দশকে ক্ষমতার নির্ধারক শক্তি হিসেবে অনিবার্য বামপন্থিরা যেন ‘নো হয়ার’ হয়ে পড়েছিল।
পরিস্থিতির উত্তরণে স্বভাবতই বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তির বদলে ঐক্য ও জোটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল বামপন্থি দলগুলো। আমরা দেখেছি, প্রথমে গণফোরামের মতো কিছু অ-বামপন্থি দলের সঙ্গেও জোটে রাজি হয়েছিল কিছু বামপন্থি দল। গঠিত হয়েছিল বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। ওয়ান-ইলেভেনের মাধ্যমে ভেস্তে যাওয়া নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে এই জোটের ভূমিকা ছিল বড় ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে দুই দশক পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রথমবারের মতো জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের শক্তি ও প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করতে পেরেছিল। কিন্তু ক্ষমতার নির্ধারক ও ক্ষমতার অংশীদার শব্দ দুটির খুব বেশিদিন নিজেদের সীমানা যে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে না, সেটা আরেকবার প্রমাণ হয়েছিল এখানে। জোটভুক্ত কয়েকটি দল বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের বদলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় এবং পরবর্তীকালে মহাজোটকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় ফ্রন্ট ভেঙে গিয়েছিল। প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছিল ফ্রন্ট।
জোটের ভাঙাগড়ার মধ্যে সম্ভাবনাময় অন্তত তিনটি বামপন্থি দল নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছিল। প্রথমে ওয়ার্কার্স পার্টি ভেঙে বিপল্গবী ওয়ার্কার্স পার্টি, তারপর বাসদ ভেঙে ‘মার্ক্সবাদী’ নামে ব্র্যাকেটবন্দি, তারপর জাসদ আরেক দফা ব্র্যাকেটবন্দি। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, নতুন আটদলীয় জোটে বাসদের দুই পক্ষই যোগ দিয়েছে। বিপল্গবী ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে সিপিবিতে গিয়েছিলেন একজন কেন্দ্রীয় নেতা। এখন সিপিবি ও বিপল্গবী ওয়ার্কার্স পার্টি
উভয়ই এই জোটে যোগ দিয়েছে। আগামী
নির্বাচন সামনে রেখে জাসদের সর্বশেষ দুই পক্ষও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে থাকবে, এটা অনেকটা অনিবার্য?
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে বিভক্ত হওয়ার দরকার ছিল কি? এই প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক, তাহলে ‘পুনর্জোটভব’ কেন প্রয়োজন হলো? উত্তর একটাই, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে। নতুন জোট আত্মপ্রকাশের দিন সংবাদ সম্মেলনে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, তাদের এই জোট ‘ইলেকশন অ্যালায়েন্স’ না হলেও ভোটের সংখ্যা ‘রূপান্তরিত করার’ চেষ্টায় থাকবে। একই সঙ্গে এটা ‘ভোটসর্বস্ব’ জোট না, সামগ্রিক আন্দোলনের। তার এই বক্তব্য ছিল তাৎপর্যপূর্ণ- ‘আন্দোলনের স্বার্থে ভোটে আমরা অংশগ্রহণ করতে পারি, বয়কটও করতে পারি’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম)।
এটা সত্য যে, আনুষ্ঠানিক বক্তব্য যাই হোক, যে কোনো রাজনৈতিক জোট দিনের শেষে ভোটই মাথায় রাখে। নতুন জোট আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের আগেই যে ভোটের বিষয়টি সামনে রেখেছিল, এ বছর মার্চে সমকালের একটি প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট। ‘৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা জোট। এ লক্ষ্যে জোটবদ্ধ নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে ভেতরে ভেতরে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছেন নেতারা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তুলতে অন্য বাম প্রগতিশীল দলের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও জানিয়েছেন জোট নেতারা’ (সমকাল, ২৪ মার্চ ২০১৮)। খোদ সিপিবি অন্তত ১৬০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ‘প্রস্তুতি’ নিয়েছে বলে একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন জোট ভোটের বাজারে কতটা সুবিধা করতে পারবে? প্রথমত, গত দুই দশকে এটা প্রমাণ হয়েছে যে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা কাঠামো বা চরিত্রের অংশ বা প্রভাবক শক্তি হয়ে ওঠার আর কোনো পথ বর্তমান বাংলাদেশে খোলা নেই। বিএনপির মতো বড় দল গত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার মাশুল গুনছে। সিপিবি, বিকল্পধারা, এলডিপির মতো যেসব দল নির্বাচন বর্জন করেছিল, তাদের অভ্যন্তরেও এখন নানা মাত্রায় সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এককভাবে নির্বাচনের চেয়ে জোটগতভাবে নির্বাচনের সুবিধাও গত দুই দশকে প্রমাণ হয়েছে। যে কারণে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টির মতো বড় রাজনৈতিক দলও প্রায় নামসর্বস্ব কিছু দলের সঙ্গে জোট গঠনকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, আগামী নির্বাচনে গতবারের বয়কট চিত্রের পুনরাবৃত্তি হবে না। সে ক্ষেত্রে বামপন্থি দলগুলো জোটবদ্ধভাবে অংশ নেওয়াই ভালো। যেমন ভালো ভোটের জন্য, তেমনই খোদ দলগুলোর ভবিষ্যতের জন্যও।
লেখক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
সুত্র-সমকাল